পরিবার ও সমাজে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে, উত্তম চরিত্র, ভূমিকা অনন্য। একজন উত্তম চরিত্রবান ব্যক্তিই পারেন, একটি সমাজ ও পরিবারকে বদলে দিতে। পারেন অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে ধাবিত করতে। কবি বলেন, যুগ জামানা উলটে দিতে চাই না অনেকজন/এক মানুষই আনতে পারে জাতির জাগরণ। সেজন্য বলা হয়, চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। আর আল্লাহতায়ালার কাছে ওই ব্যক্তিই উত্তম, যে উন্নত চরিত্রের অধিকারী (বোখারি-৬০৩৫।নিম্নে উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
1সত্যবাদিতা>
উত্তম চরিত্রের অন্যতম একটি সত্যবাদিতা। হাদিসের বাণী, সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা অবশ্যই সত্যের পথ অবলম্বন করবে। কারণ সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায় (জামে তিরমিজি-১৯৭১।
2আমানতদারিতা>
এটি এক মহৎ গুণ। এ গুণের কারণে রাসূল (সা.) নিজ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আল আমিন-বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানতগুলো তার হকদারের কাছে পৌঁছে দিতে (সূরা আন নিসা-৫৮।
3মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার
‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগি কর। তার সঙ্গে কাউকে শরিক কর না। বাপ-মার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বসঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন বাদী ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ, আল্লাহ এমন কোনো ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না যে, আত্ম-অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং নিজের বড়াই করে’ (সূরা নিসা আয়াত ৩৬।
4আত্মীয়তার সম্পর্ক
ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এসব যারা করবে, তাদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, ‘অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন’ (সূরা মুহাম্মাদ ২২, ২৩)রাসূল বলেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না (বোখারি-৫৮৮৪)।
5অঙ্গীকার পূর্ণ করা
অঙ্গীকার পূর্ণ করার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাসের আস্থা বৃদ্ধি পায়। সে কারণে ইসলাম অঙ্গীকার পূর্ণ করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। কেননা অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪।
উত্তম চরিত্র গঠনের উপায়
উত্তম চরিত্র মানুষের প্রকৃত ইমানের প্রমাণস্বরূপ। চরিত্র ব্যতীত ইমান প্রতিফলিত হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (আবু দাউদ)
যা উত্তম চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বলে মনে করা হয়। সেগুলো তুলে ধরা হলো।
সত্যবাদিতা< আল্লাহতায়ালা ও তার রাসুল (সা.) আমাদের যেসব চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতা। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সুরা তাওবা ১১৯)
বিনয় ও নম্রতা>উত্তম চরিত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে বিনয় ও নম্রতা। একজন মুসলমান তার অন্য মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরিব হোক। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা বিনয়ী হও। একজন অন্যজনের প্রতি অহংকার কোরো না এবং একজন অন্যজনের ওপর সীমালঙ্ঘন কোরো না।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা> আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব। আর তা ছিন্ন করা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং অভিশাপের কারণ। কোরআনে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ওইসব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহতায়ালা অভিশাপ করেছেন। তিনি তাদের বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।’ (সুরা মুহাম্মদ ২২-২৩)
ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা> ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা হলো উত্তম চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ধৈর্যধারণ ও ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভুক্ত’। (সুরা শুরা ৪৩)
ন্যায়পরায়ণতা> ন্যায়পরায়ণতা আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইনসাফ করো, এটা তাকওয়ার অতীব নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়িদা ৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে, সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, তখন সে যেন তার খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত করো। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত করো। তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করো।’
উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব
উত্তম চরিত্র, মানুষের স্বভাব-চরিত্র, মেজাজ-মর্জি ও আচরণ বোঝানোর জন্য আরবিতে আখলাক শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দয়া, ক্ষমা, ধৈর্য, বিনয়, সততা, সুন্দর আচরণ মানবচরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই বলা হয়, তাই উত্তম চরিত্রবানই উত্তম ঈমানদার। আখলাক তিন প্রকার: ১. আখলাকে হাসানা: কেউ জুলুম করলে সমপরিমাণ বদলা নেওয়া। ২. আখলাকে কারিমা: জুলুম করলে তা মাফ করে দেওয়া। ৩. আখলাকে আমিমা: জালেমের জুলুম মাফ করে দেওয়ার পর তার প্রতি ইহসান বা উপকার করা। উত্তম চরিত্রবান ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য রাগ সংবরণ করে ফেলে, সৎ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, মানুষের সঙ্গে কটুবাক্য ব্যবহার করে না।
উত্তম চরিত্র সম্পর্কে কুরআনের আয়াত
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “আল্লাহ তায়ালা কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে এগিয়ে আসে”। (সূরা আর-রা’দ-১১)
নবী করীম সা.বলেন, “আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে”। মানব জীবনে আখলাকের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ তার মনের আলোকেই সম্পাদিত হয়। দার্শনিক ঈমাম গাজ্জালীর মতে-যেমন গুণাবলী মানব মনে জাগরুক থাকে তারই প্রতিফলন তার বাহ্যিক কাজ-কর্মে প্রকাশিত হয়। এর আলোকে বলা যায় মানুষের কোন কাজই তার মূল চিন্তা-চেতনা বহির্ভূত নয়। এ জন্যই যুগে যুগে সংস্কারকরা মানুষের সংশোধন ও পবিত্র জীবন যাপনের পন্থা হিসেবে তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও মূল্যবোধের জ্ঞান প্রথমেই শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের উন্নতি-অবনতি, উত্থান-পতন, মান-সম্মান
তাদের মানসিক বিকাশ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার ওপরই নির্ভর করে।
উত্তম চরিত্র ইসলামী শিক্ষার অন্যতম একটি কোর্স হিসেবে পরিগণিত করা হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা সমগ্র মানব সমাজের চারিত্রিক উন্নয়নে প্রচুর নির্দেশনা বিদ্যমান। মূলত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এ চরিত্রের আলোকেই হয়ে থাকে। আখলাকের মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত মানে উন্নীত হতে পারে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। এ বিধানের পরিপূর্ণতার জন্য তাতে উন্নত চরিত্রের বিধান থাকা আবশ্যক। তাই ইসলামে আখলাকুল হাসানাহ্ তথা উত্তম চরিত্রের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের নিমিত্তে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসূলদের প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী সা. কে প্রেরণের অন্যতম কারণ সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধন। একদা জনৈক ব্যক্তি রসূল সা.কে দ্বীনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন: “উত্তম চরিত্র”। এ কথা দ্বারা বুঝা যায় সচ্চরিত্রতা বা উত্তম চরিত্র দ্বীনের অন্যতম একটি রুকন, যা ব্যতীত দ্বীনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না, যেমন হজ্ব সম্পর্কে রাসূলের বাণী: “হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন হচ্ছে আরাফায় অবস্থান করা” যা ব্যতীত হজ্ব আদায় হয় না, তেমনি ভাবে সচ্চরিত্রতা ব্যতীত দ্বীন ও পরিপূর্ণ হয় না।
উত্তম চরিত্র হল পরকালে মুক্তির উপায়, ইসলামের অপরিহার্য ফরজ তথা নামাজ-রোযা পালন করা সত্তে¡ও পরকালে জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাত লাভের জন্য আখলাক তথা উত্তম চরিত্রের কোন বিকল্প নেই। একদা এক ব্যক্তি রসূল সা. কে নামাজী ও রোজাদার হওয়া সত্তে¡ও প্রতিবেশীদের কষ্টদানকারিণী জনৈকা মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, সে জাহান্নামী” এবংকি মু’মিনদের মান ব্যবধান হবে উত্তম চরিত্র দ্বারা। জনৈক ব্যক্তি রসূল সা. কে উত্তম ঈমানদার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে যে অধিক চরিত্রবান সেই উত্তম”। উত্তম চরিত্র দ্বারা মু’মিনরা কেয়ামতে রাসূল সা.এর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সবাই এক রকম হবে না। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা.বলেন, ‘কেয়ামতের দিবস তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে তোমাদের মধ্যে যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী’।
সৎ চরিত্রের অধিকারীর আমলনামাও ভারী হবে। এ প্রসঙ্গে রসূল বলেন, ‘কেয়ামতের মাঠে হিসেব-নিকাশের সময় ’আল্লাহ ভীতি ও চরিত্রতার গুণ’ মু’মিনের আমলনামাকে ভারী করবে।’
রাসূল সা. এর উত্তম আখলাক সম্পর্কে দোয়া করতেন, তিনি নিজে গুণাহমুক্ত হয়েও নিজের চরিত্র সুন্দর করার তৌফিক অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। যেমন তিনি দোয়ায় বলতেন, “আল্লাহ তুমি আমার গঠন-আকৃতি সুন্দর করেছ, আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও”। আল্লাহ তায়ালা রসূল সা. এর উত্তম চরিত্রের প্রশংসাও করেছেন, তিনি বলেন, “আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত”। (সুরা কলম-৪) আয়াতে মহান আল্লাহ কর্তৃক রসূল সা.এর আখলাকের প্রশংসা করেছেন। পবিত্র কুরআনের প্রচুর আয়াতে আখলাকের বিবরণ ও চরিত্রবানদের প্রশংসার বাণী উদ্ধৃত হয়েছে, মাক্কী ও মাদানী উভয় সূরাগুলোতে আখলাকের নির্দেশ বেশি থাকায় এর গুরুত্বেরও আধিক্য বুঝা যায়, যা থেকে কোন মুসলিমের দূরে থাকা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার রাসূল সা. এর উত্তম চরিতে চরিত্রবান করুন। আমিন।
উত্তম চরিত্রের ঘটনা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বন্ধু ও শত্রু সকলের মুখে সমভাবে তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। কঠোর প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সম্মুখে অকুণ্ঠ চিত্তে তাঁর সততা, আমানতদারী ও সচ্চরিত্রতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন (বুখারী হা/৭)। আল্লাহপাক নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলম ৬৮/৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’।[1] তাই দেখা যায়, নবুঅত-পূর্ব জীবনে সকলের নিকটে প্রশংসিত হিসাবে তিনি ছিলেন ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত, আমানতদার) এবং নবুঅত পরবর্তী জীবনে চরম শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশেও তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতা, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা, দয়া ও সহমর্মিতা, পরোপকার ও পরমত সহিষ্ণুতা, লজ্জা ও ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলীর জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং খালি চোখে আকাশের তারকারাজি গণনা করা অসম্ভব। তবুও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু চারিত্রিক নমুনা ও বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-
(১) বাকরীতি (تعبير الكلام) : তিনি হাসিমুখে বিশুদ্ধ, মার্জিত ও সুন্দরভাবে কথা বলতেন। যা দ্রুত শ্রোতাকে আকৃষ্ট করত। আর একেই লোকেরা ‘জাদু’ বলত। তাঁর উন্নত ও শুদ্ধভাষিতায় মুগ্ধ হয়েই ইয়ামনের যেমাদ আযদী মুসলমান হয়ে যান।[2] নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ‘তিনি ছিলেন আরব ও অনারবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ’।[3] এমনকি ‘হাদীছ জাল হওয়ার অন্যতম নিদর্শন হ’ল তার শব্দসমূহের উচ্চ মানবিশিষ্ট না হওয়া’ (ফাৎহুল মুগীছ)। একারণেই আরবী সাহিত্যে কুরআন ও হাদীছের প্রভাব সবার উপরে। বরং বাস্তব কথা এই যে, এই ভাষার বুকে কুরআন ও হাদীছের অবস্থানের কারণেই তা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর কুরআন ও হাদীছের সর্বোচ্চ বাকরীতি ও আলংকরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আরবী ভাষা ও সাহিত্য সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন হ’তে পেরেছে এবং ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। অথচ হিব্রু, খালেদী, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা সমূহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে।
(২) ক্রোধ দমন শৈলী (أسلوب كظم الغيظ) > ক্রোধ দমনের এক অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি বলতেন, প্রকৃত বীর সেই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে দমন করতে পারে।[4] আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনি কখনো কাউকে নিজের স্বার্থে নিজ হাতে মারেননি। কোন মহিলা বা খাদেমকে কখনো প্রহার করেননি’।[5]
(৩) হাসি–কান্না (الضحك والبكاء)> তিনি মৃদু হাস্য করতেন। কখনোই অট্টহাস্য করতেন না। সদা প্রফুল্ল থাকতেন। কখনোই গোমড়ামুখো থাকতেন না। তবে দুশ্চিন্তায় পড়লে তার ছাপ চেহারায় পড়ত এবং তখন তিনি ছালাতে রত হ’তেন।[6] ছোটখাট হালকা রসিকতা করতেন। যেমন, (ক) একদিন স্ত্রী আয়েশার নিকটে এসে তার এক বৃদ্ধা খালা রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন যেন তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একথা শুনে উক্ত মহিলা কাঁদতে শুরু করল। তখন আয়েশা বললেন, তাদের কি দোষ জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআনে পড়োনি যে আল্লাহ বলেছেন,إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً- فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا- عُرُبًا أَتْرَابًا- لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ ‘আমরা জান্নাতী নারীদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি’। ‘অতঃপর তাদের চিরকুমারী করেছি’। সদা সোহাগিনী, সমবয়স্কা’। ‘ডান সারির লোকদের জন্য’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৩৫-৩৮)।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জান্নাতবাসী নারী-পুরুষ সবাই ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী হবে’।[8]
(খ) এক সফরে তিনি দেখেন যে, মহিলাদের নিয়ে তাঁর কৃষ্ণকায় উষ্ট্রচালক গোলাম আনজাশাহ দ্রুত গতিতে উট হাঁকিয়ে চলেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন,رُوَيْدَكَ يَا أَنْجَشَةُ، لاَ تَكْسِرِ الْقَوَارِيرَ ‘ধীরে চালাও হে আনজাশা! কাঁচের পাত্রগুলি ভেঙ্গে ফেল না’।[9] (গ) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের সঙ্গে মিশতেন। এমনকি আমার ছোট ভাই আবু ওমায়ের একটি ‘নুগায়ের’ অর্থাৎ লাল ঠোট ওয়ালা চড়ুই জাতীয় পাখি পুষত। যা নিয়ে সে খেলা করত। রাসূল (ছাঃ) যখন এসে তাকে খেলতে দেখতেন, তখন বলতেন, يَا أَبَا عُمَيْرٍ مَا فَعَلَ النُّغَيْرُ ‘হে আবু ওমায়ের! কি করছে তোমার নুগায়ের[10]
ছালাতের মধ্যে বিশেষ করে তাহাজ্জুদের ছালাতে তিনি আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখলে তার অন্তর কেঁদে উঠতো এবং তার অভাব দূরীকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। চাচা হামযা, কন্যা যয়নব ও পুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুতে তিনি শিশুর মত হু হু করে কেঁদেছিলেন। তিনি অন্যের মুখে কুরআন শুনতে পসন্দ করতেন। একবার ইবনু মাসঊদের মুখে সূরা নিসা শুনে তাঁর চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়। অতঃপর ৪১ আয়াতে পৌঁছলে তিনি তাকে থামতে বলেন11]
চরিত্র নিয়ে ইসলামিক উক্তি
রসুলুল্লাহ (সা.) উত্তম চরিত্র নিয়ে যা বলেছেন>রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট। কোরআন ও তার চরিত্র দুটো একই বলে ঘোষণা করেছেন উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)।
উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব সংক্রান্ত হাদিসসমূহ
হজরত আবু হুরাইরাহ (রা.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিনদের মধ্যে সবার চেয়ে পূর্ণ মুমিন ওই ব্যক্তি যে চরিত্রে সবার চেয়ে সুন্দর, আর তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজের স্ত্রীর জন্য সর্বোত্তম। (তিরমিজি ১১৬২)
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মানুষের মাঝে ওই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় যে তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উত্তম চরিত্রের অধিকারী। (ইবনে মাজাহ ৩৪৩৬)
হজরত আবু জার (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছেন, তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর, পাপ করলে সাথে সাথে পুণ্যও কর; যাতে পাপ মোচন হয়ে যায় এবং মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার কর। (তিরমিজি ১৯৮৭)
আন-নওয়াস ইবনু সামআন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উত্তম চরিত্র হচ্ছে নেকি, আর গুনাহ তাকে বলে যা তোমার মনকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে এবং তা লোকে জানুক তা তুমি অপছন্দ কর। (মুসলিম ২৫৫৩)
উত্তম চরিত্রের প্রতিদান বিষয়ে হাদিসসমূহ
হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেয়ামতের দিন নেকি ওজন করার দাঁড়ি-পাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে কোনো বস্তুই অধিক ভারী হবে না। আর আল্লাহ তাআলা অশ্লীল ও চোয়াড়কে অপছন্দ করেন। (তিরমিজি ২০০৩)
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘কোন আমল মানুষকে বেশি জান্নাতে নিয়ে যাবে?’ তিনি বললেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আর তাঁকে (এটাও) জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘কোন আমল মানুষকে বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে?’ তিনি বললেন, মুখ ও যৌনাঙ্গ (অর্থাৎ, উভয় দ্বারা সংঘটিত পাপ)। (তিরমিজি ২০০৪)
হজরত আবু উমামাহ বাহেলী (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের শেষ সীমায় একটি ঘর দেয়ার জন্য জামিন হচ্ছি, যে সত্যাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও কলহ-বিবাদ বর্জন করে। সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যে উপহাসের ছলেও মিথ্যা বলা বর্জন করে। আর সেই ব্যক্তির জন্য আমি জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি ঘরের জামিন হচ্ছি, যার চরিত্র সুন্দর। (আবু দাউদ ৪৮০২, তিরমিজি ১৯৯৩)
মন্দ চরিত্র নিয়ে হাদিসে যা আছে
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিন খোঁটাদানকারী, অভিশাপকারী, অশ্লীল এবং অসভ্য হয় না। (আহমাদ ৩৮৩৯)
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা একে অপরের প্রতি হিংসা করো না, (ক্রয় করার ভান করে) মূল্য বৃদ্ধি করে ধোঁকা দিও না। একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। একে অপরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন (অবজ্ঞা প্রকাশ) করবে না। তোমাদের একজনের ক্রয় করা শেষ না হলে ওই বস্তুর কেনা-বেচার প্রস্তাব করবে না। হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও। মুসলিম মুসলিমদের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, অসম্মান করবে না, তুচ্ছ ভাববে না। (বুখারি ৫১৪৪)
Read more>